বুয়েটকাল [কিস্তি ২]



শাকুর মজিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 কিস্তি ১. কেমন করে বুয়েটে গেলাম

মেডিক্যাল হোস্টেলের প্যারাসাইট জীবন 

১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ঢাকা চলে আসি। বিদেশ থেকে বাবার আনা একটা স্পঞ্জের তোশক  আর একটা বিদেশি লাল রঙের কম্বল ছিল আমার খুব প্রিয়। ১৯৭৮ সালে কালো রঙের যে টিনের বাক্স নিয়ে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে গিয়েছিলাম সেই ট্রাঙ্কটি প্রায় অক্ষতই ছিল। শুধু তাই নয়, এই ট্রাঙ্কে সাদা রঙ (এনামেল পেইন্ট) দিয়ে নিজের হাতে নিজের যে নাম লিখেছিলাম, সেই নামটিও প্রায় অক্ষত অবস্থায় আছে। সেই ট্রাঙ্কের ভেতর আমার সমূহ সম্পত্তি, মানে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার কাটিং স্ক্রেপ বুক, নানা রকমের লিটিল ম্যাগাজিন, কিছু ফটোগ্রাফ, দুই জোড়া জুতা, স্যান্ডেল, কাপড়-চোপড় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য চলে আসি। এসে উঠি মহাখালীতে আমার বাবার এক চাচার বাসায়। এসে বলি, কাল পরশুর মধ্যে আমার হলের সিট হয়ে যাবে, চলে যাব। কিন্তু আমি তো জানি কাল-পরশুর মধ্যে আমার সিট কী করে হয়! অফিসিয়ালি ক্লাস শুরু হতে আরো দুইমাস বাকি। আমি শুনেছি টিউশনি করে অনেক টাকা কামানো যায়। আমি সেই উদ্দেশ্যে আগাম চলে আসি ঢাকায়।

বাবা মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। বাড়িতে মা আছেন, আর আছে ছোট ছোট ৪ ভাই বোন। আমি সবার বড়। বাবা মারা যাবার পর বাবার প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল সে টাকার একটা বড় অংশ নিয়েছেন আমাদের এক আত্মীয়। তিনি এই টাকায় ব্যবসা করছেন। মাকে মাসে মাসে টাকা দেন, তার খরচ চলে যায়। বাকি সামান্য যে কিছু টাকা আছে তা থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে চলে এসেছি ঢাকায়। ঢাকার জীবন শুরু হবে এখান থেকে।

মহাখালী থেকে ৬ নং বাসে হাইকোর্ট, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বকশী বাজারে ডাঃ ফজলে রাব্বী হল।

সেখানে আলাউদ্দিন আছে। ক্যাডেট কলেজে একসাথে ছিলাম ৬ বছর। বেশ কয়েকবার একই রুমেও। শুনেছি এসব হলে ছাত্রদের সাথে থাকা যায়। আমাকে দেখে আলাউদ্দিনের খুব উচ্ছ্বাস । এটা কোনো ব্যাপার হলো! আমাদের থ্রি সিটেট রুম। একটা বিছানা খালিই থাকে। যার জন্য এলোটেড ঢাকায় তার বাসা ঢাকায়, সে মাঝে মাঝে আসে, সমস্যা নাই, তখন আমরা ডাবলিং করব। তুই চলে আয়।

পরদিনই লেপ-তোশক নিয়ে ঢাকা এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. ফজলে রাব্বাী হলের ২১ নম্বর রুমে উঠে পড়ি। তাদের ক্লাস শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগেই। এই রুমে আলাউদ্দিনের আরেক রুমমেট আছে, হুমায়ূন। আমি তাকেও খাতির করে চলি। মাঝে মাঝে সিঙারা এনে খাওয়াই। তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, যত তাড়াতাড়ি আমি বিদায় হই, ততই তাদের মঙ্গল। হুমায়ূন আমাকে প্রায়ই জিগ্যেস করে, তোমার সিট হয় নাই ?

আমি মুখে কিছু না বলে, মাথা নাড়াই।

মেডিকেলের হোস্টেলে এ রকম বেশ কিছু বহিরাগত থাকে। ছাত্রদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন। এদেরকে বলা হয় প্যারাসাইট। এ রকম আরো প্যারাসাইটের খোঁজ পেলাম ৮ নং রুমে।

ডা. ফজলে রাব্বী ছাত্রাবাসের ৮ নম্বর রুমটা বেশ জটিল। সেখানে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের আমাদের ব্যাচের তিনজন থাকে। তারা জেনুইন মেডিকেল স্টুডেন্ট। আর দুইজন থাকে প্যারাসাইট। একজন ঝিনাইদহ, আরেকজন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের। প্যারাসাইট-প্যারাসাইট ভাই ভাই, তাদের মধ্যে খুব দ্রুত খাতির হয়ে যায়। এদের দুইজনের সাথেই আমার খাতির হয়ে গেল। একজনের নাম নাদীম। তার সঙ্গে আমার পত্রমিতালী ছিল। ইয়াং অবজারভারের পেন-প্যাল বিভাগে একবার আমার নাম ঠিকানা ছাপিয়েছিলাম। কয়েকটা মেয়ে আর কয়েকটা ছেলে আমাকে চিঠি লিখেছিল। একটা ছেলে লিখেছিল ইংরেজিতে। তার নাম ছিল নাদীম।  সে ইংরেজিতে খুব ভালো। ইংরেজি পত্রিকা পড়ে। তার বিছানায় টাইমস-নিউজ উইক, স্টার ডাস্ট থাকে। আমি মাঝে মাঝে নিয়ে উল্টাই। আর ভাবি, এখানে কী কী আছে যা অনুবাদ করা যায়। কারণ এর মধ্যেই আমি অনুবাদের কিছু কাজ করে কয়েকশো টাকা আয় করে ফেলেছি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ৮ নম্বর কামরার অরিজিনাল বাসিন্দা বাবু। সে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের। বাবুর একটা অটোফোকাস ক্যামেরাও আছে, ইয়াসিকা এমএফটু। চা-সিঙারা খাইয়ে বাবুর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করি। বাবুর ক্যামেরায় টিপ দিলেই ছবি ওঠে। ছবি তুলতে খুবই আনন্দ আমার। হোস্টেলের সামনে আলিয়া মাদ্রাসার গেটের কাছে ভিখিরিদের ছবি তুলি, নিউ মার্কেটে নিয়ে ফিল্ম প্রসেস করি। বি-টু সাইজের ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে আসি। ১০ টাকায় পাঁচ কপি প্রিন্ট করা যায়।

একজন একটি টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছে। মন্ত্রী মাইদুল ইসলামের বোনকে (নাম সম্ভবত পলি) পড়াই। সপ্তাহে তিন দিন। মাসে ৬০০ টাকা বেতন। টিউশনি শেষে আমার হাতে অনেক সময়, আমি আরো কিছু কাজ চাই।

একসময় বাবু বলে, ‘তুই তো লিখতে পারিস, পত্রিকায় লেখ না, অনেক টাকা পাওয়া যায়।’

পত্রিকায় ছাপার হরফে কেবল লেখা দেখেই তুষ্ট ছিলাম এত দিন। এখন শুনলাম, এখান থেকে টাকাও আসে। বিষয়টি মাথায় চক্কর দিতে থাকে। সিলেটের গ্রাম থেকে ডাকযোগে কয়েকটি লেখা পাঠিয়েছিলাম এক পত্রিকায়, কিছু কবিতা, কিছু গল্প। একটি কবিতা এবং একটি গল্প ছাপা হয়েছে অনেক আগে। তাহলে কি এগুলোর জন্য টাকা পাওয়া যাবে?

অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে হাজির হই টিকাটুলির অভয় দাস লেনের ১৩/বি বাড়িতে। এই বাড়ি থেকে বেরোয় মাসিক রোকসানা। সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হয় সৈয়দা আফসানার, কিন্তু পত্রিকা দেখেন প্রায়বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক। তিনিই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত পাইলট রোকসানার বাবা। মেয়ের নামে পত্রিকা বের করছেন। তাঁর বাসার ড্রয়িংরুমই পত্রিকার অফিস।

পত্রিকার একজন লেখক দেখা করতে এসেছেন শুনে তিনি খুবই খুশি। তিনি কোন্ আইসক্রিম আনিয়ে খাওয়ান আমাকে। আইসক্রিম খাওয়ার ফাঁকে তাঁর কাছে আমার মনোবাসনা উত্থাপন করি। লেখার জন্য সম্মানী পাওয়া যায় কি না, জানতে চাই।

চশমার ফাঁক দিয়ে তিনি তাকান আমার দিকে। বলেন, কিছু ফিচার, অনুবাদ, এসবের কাজেই তিনি লেখকসম্মানী দেন, যত পৃষ্ঠা ছাপা হবে ততশো টাকা, এটা তাঁর পত্রিকার নিয়ম। জানতে চান, আমি কোন বিষয়ে লিখতে আগ্রহী। বলি, অনুবাদ করতে পারব। দেন।

তিনি প্রথমে একটা রিডার্স ডাইজেস্ট দিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ওপর একটা লেখার অনুবাদ করতে বলেন। আমি এই টেক্সটের সাথে ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে আরো কিছু জোগাড় করে লিখে দিলাম। তিনি পড়লেন এবং ড্রয়ার থেকে দু’শো টাকা বের করে দিয়ে দিলেন। বললেন, এরকম ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে নিয়ে আসবেন।

আমি নাদীমের সাথে খাতির লাগাই। তার কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য ইংরেজি পত্রিকা নিয়ে আলিয়া মাদ্রাসার গেটের কাছে ফটোকপি করিয়ে ফেরত দিয়ে দিই। রাত জেগে লেখা অনুবাদ করে  মাসিক রোকসানা পত্রিকার অফিসে চলে যাই।

একদিন সম্পাদক পিতাকে (যিনি সম্পাদিকা তাঁর সাথে দেখা হয়নি। পিতার সাথেই দেখা হতো) বলি, আমি হুমায়ূন আহমেদের একটা ইন্টারভিউ করতে চাই। করব?

তিনি রাজি হয়ে গেলেন।

আমি মেডিকেল হোস্টেলে এসে হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই। ফোন করার জন্য বারান্দায় কয়েন বক্সের সামনে লাইনে দাঁড়াতে হয়। আমাদের মতো প্যারাসাইটদের লাইনে দেখলে হোস্টেলের অরিজিনাল ছাত্ররা বিরক্ত হয়। কিন্তু উপায় নেই। আমাকে ফোন করতে হবে। আমি কয়েকটা সিকি হাতে নিয়ে দাঁড়াই এবং একসময় লাইনের সামনে এসে ফোন ধরার সুযোগ পাই। ফোন করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সচেঞ্জে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ড. হুমায়ূন আহমেদকে চাই। ওপাশ থেকে অপারেটর সংযোগ ঘটিয়ে দেন সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে কার্জন হলে। সেখানে যিনি ফোন ধরলেন, তিনি খুবই দয়াবান এক ভদ্রলোক। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর তিনি আমাকে জানালেন, ড. হুমায়ূন আহমেদ এখন তাঁর রুমে নেই, তিনি বাসায় চলে গেছেন। তিনি তাঁর বাসার ফোন নম্বরটি দিয়ে দেন।

সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে আরো দুটি সিকি ঢুকে যায় কয়েন বাক্সের ছিদ্র দিয়ে। ওপাশে ফোন ধরেন স্বয়ং ড. হুমায়ূন আহমেদ। ঠিক হয় কাল বিকাল তিনটায় আমি তাঁর বাসায় যাব। আমার সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফারও থাকবে।

কাল বিকেল তিনটা, এখন থেকে প্রায় ২২ ঘণ্টা বাকি। আমার চোখে মুগ্ধ হওয়ার স্বপ্ন। বাবুকে সব ঘটনা খুলে বলি। বাবু উৎসাহী হয়ে পড়ে। সে প্ল্যান করেছে, তার ক্যামেরার সাথে রুমের বড় টেপ-রেকর্ডারটাও নিয়ে যাবে। সারা রাত জেগে নোটবুকে কতগুলো প্রশ্ন লিখে রাখি। হাতের কাছে ছিল একটা উপন্যাস, ‘তোমাকে’, সেটাও পড়ে ফেলি। আমি এই প্রথম পর পর দুইদিন সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করে করে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তারিখটা ছিল ২১ ও ২২ জানুয়ারি ১৯৮৬।

ডাঃ ফজলে রাব্বি হলের ৮ নং রুমে আরেকজনের সাথে পরিচয় হয়। নাম তৌকীর। সেও নাকি বুয়েটে চান্স পেয়েছে। আর্কিটেকচারে। তবে তাকে গভীর রাত না হলে রুমে পাওয়া যায় না। বিকেলে টিউশনি করে। এক ছাত্রীকে বাড়ি গিয়ে ড্রয়িং শেখায়, আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দেবে মেয়েটি। আবার এক কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়। প্রতি ক্লাসে ১০০ টাকা পায়। তার ভালো ইনকাম। সে আবার ‘থিয়েটার’ দলেও নাকি চান্স পেয়েছে। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা যায়।

এরমধ্যে একদিন এই হোস্টেলের ঠিকানায় রি-ডাইরেক্ট করা রেজিস্টার্ড উইথ এডি একটা খাম আসে আমার কাছে। খামের ওপরে লেখা—রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহৃত। খুলে দেখি সিলেট বেতারের একটা চুক্তিপত্র আর ৪৮০ টাকার মানি রিসিট। সেখানে লেখা—‘যে যাহা করো রে বান্দা আপনার লাগিয়া  নামক সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার নাটকটি আগামী ১৭ জানুয়ারি সিলেট বেতার থেকে প্রচার হবে।’

আমি মহা উত্তেজিত হয়ে খবরটি তৌকীরকে জানাই। সে তখন থিয়েটারে নতুন ডাক পেয়েছে। প্রতিদিন ওয়ার্কশপে যায়, ফেরে গভীর রাতে। আমার ইচ্ছা করে তার সাথে নাটকের রিহার্সালের গল্প শুনতে। কিন্তু তাকে ফ্রি পাওয়া যায় না।

আর আমি ছোট্ট একটা অটোফোকাস ইয়াশিকা এমএফটু ক্যামেরা নিয়ে ঘুরি। ছবি তুলি। দুয়েকটা পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপিয়ে পরের সপ্তাহ থেকে সেই পত্রিকা অফিসে বিল সংগ্রহের জন্য ঘুরে ঘুরে সময় কাটাই আর নতুন টিউশনি খুঁজি। এই নিয়ে সময় কাটাতে কাটাতে সপ্তাহ দুই পরে তিতুমীর হলের সিটে আমার জায়গা হয়। আমি বুয়েট জীবন শুরু করি। ১৯৮৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় আমাদের ক্লাস। তার কিছুদিন পর বুয়েটের তিতুমীর হলের ১০৬ নং রুমে আমার ঠাঁই হয়। শুরু হয় আসল বুয়েটকাল।

কিস্তি ৩. বুয়েটপরশ

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;